নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক কলস বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য গণ হাহাকার শুরু হয়েছে। অবৈধ সেচ পাম্পের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে প্রায় সকল টিউবওয়েল(পানির কল) অচল হয়ে গেছে।সাম্প্রতিক প্রচণ্ড দাবদাহে চারপাশে হাঁসফাঁস শুরু হয়েছে।
শুক্রবার (৯ মে) সকালে সরেজমিনে পূর্ব চরবাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় একটি এনজিওর পানির গাড়ি আসার খবরে শত শত নারী, পুরুষ ও শিশু হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। বেলা সাড়ে ১১টায় বেসরকারি সংগঠন ‘সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’র গাড়ি দেখে মসজিদের মাইকে পানির গাড়ি আসার ঘোষণা দেয়া হয়। মুহূর্তে এক কলস খাবার পানির জন্য প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে স্থানীয়রা। পানি শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কলস নিয়ে গাড়ি ঘিরে ধরেন তারা। আগে না নিলে পানি পাবে না, তাই কলস নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু করেন তারা।
জানা গেছে, ইরি-বোরো চাষে অপরিকল্পিতভাবে অসংখ্য অবৈধ সেচ পাম্পে পানি তোলার কারণে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে সুবর্ণচরে ভূগর্ভস্থ বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়। তবে এবার এ সংকট অন্যবারের তুলনায় বেশ প্রকট আকার ধারণ করেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চার-পাঁচ বছর আগেও সুবর্ণচরে এমন চিত্র ছিল না। তখন এলাকায় বোরো চাষ হতো কম। বেশিরভাগ মানুষ রবিশস্য উৎপাদন করত। তাতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার তেমন ছিল না। কৃষিকাজের জন্য ২৪৫টি সেচ পাম্পের অনুমতি থাকলেও অপরিকল্পিতভাবে বসানো হয়েছে আরও তিন হাজারের বেশি সেচ পাম্প(শ্যালো টিউবওয়েল)। এতে দিনদিন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বেড়েছে।
পানি সংগ্রহ করতে আসা সুবর্ণচরের পূর্ব চরবাটা গ্রামের গৃহিণী বিবি আমেনা (৪০) জানান, বাড়িতে নলকূপ আছে কিন্তু পানি উঠছে না। আশপাশের বাড়িতেও একই অবস্থা। তাই সুপেয় পানির জন্য এনজিওর গাড়ির ওপর ভরসা করতে হয় সবাইকে। খাবার পানির পাশাপাশি গোসল, ধোয়ামোছাসহ শৌচাগার ব্যবহারেও চরম কষ্টে দিনাতিপাত করছি আমরা।
এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ি থেকে পানি নিয়ে ফিরছিলেন শহিদা খাতুন (৪৫)। তিনি বলেন, রমজানের ঈদের পর স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গাড়িতে কিছুদিন পানি দেয়া হয়। এরপর সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। সংস্থাটি একটি গাড়িতে পানি দিচ্ছে। এতে কোনো রকম চলে, গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো হলে আমাদের অনেক উপকার হতো।
সুবর্ণচরের ভূঁইয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা আবু মুসা (৬৫) বলেন, খাওয়ার পানির কষ্টতো আছেই। এখন পুকুরগুলোও সব শুকিয়ে যাচ্ছে। গোসল আর ধোয়া-মোছার পানির সংকটও বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আরও বেশি নজর দেয়ার দাবি এ বৃদ্ধের।
সাগরিকা সমাজ উন্নয়ন সংস্থার প্রধান নির্বাহী সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ২১ এপ্রিল কক্সবাজার থেকে জনস্বাস্থ্যের একটি গাড়ি সংগ্রহ করে তা দিয়েই জরুরি ভিত্তিতে উপজেলা শহরের ১০-১২টি পয়েন্টে বিনামূল্যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। দেড়-দুই কিলোমিটার দূর থেকে নারীরা গাড়ির কাছে আসেন পানি নিতে। অনেকে পানি না পেয়ে খালি হাতে ফেরত যান। যা খুবই কষ্টের।
তিনি আরও বলেন, একটি গাড়িতে দৈনিক দুই দফায় ৮ হাজার লিটার পানি বিতরণ করা হচ্ছে। সরকার নানাভাবে পানি সংকট সমাধানে কাজ করছে। তিন লাখ ৫৬ হাজার মানুষের এই উপজেলার অসংখ্য পরিবার এ সুবিধার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আমরা বেসরকারিভাবে ছোট পরিসরে হলেও সংকট নিরসনে চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে এটি বাড়ানো হবে।
সুবর্ণচরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন "চন্দ্রকলি"র নির্বাহী পরিচালক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, কৃষি বিভাগের ভুল নীতির কারণে সুবর্ণচরে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। রবিশস্য অধ্যুষিত এলাকায় বোরো ধান চাষ না করার বিষয়ে কৃষি আইন আছে। অথচ স্থানীয় কৃষি বিভাগ এ আইন মানছে না।
পূর্ব চরবাটা, হাজীপুর ও চরমজিদ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, আমার ব্লকে এবার এক হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষ হয়েছে। এখানে ২৫টি শ্যালো ও দুটি গভীর নলকূপসহ বিএডিসির একটি সোলার পাম্পেও পানি তোলা হয়। অতিরিক্ত চাপে এখন পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।
সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ২০২২ সালের পর এবারই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বেশি নিচে নেমেছে। শুধুমাত্র ইরি-বোরো চাষ বৃদ্ধির কারণে এমন পরিস্থিতি কিনা তা যাচাই করা হচ্ছে। এ নিয়ে রোববার (১১ মে) উপজেলায় উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, সুবর্ণচরের পানির সংকটাপন্ন অবস্থা দেখতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের(বিএডিসি)চেয়ারম্যান রুহুল আমিন খান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ছাইফুল আলমসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা নোয়াখালী আসছেন। তারা বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে রোববার (১১ মে) সকালে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে পানি সংকট নিরসনে করণীয় শীর্ষক জরুরী মতবিনিময় সভায় যোগ দেবেন।
সম্পাদক -জুয়েল রানা লিটন, অফিস : নোয়াখালী প্রেসক্লাব, মাইজদী কোর্ট, নোয়াখালী।